টেক জায়ান্ট স্যামসাং এর ইতিহাস ও কিছু মজার তথ্য
আমরা প্রতিদিন যেসকল প্রযুক্তি পন্য ব্যাবহার করি তার মাঝে শীর্ষ একটি ব্রান্ড হল স্যামসাং। এর চলার পথটি কখনই মসৃণ ছিলো না। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন এর মাধ্যমেই স্যামসাং আজকের এই শীর্ষ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। না, দাড়িয়েছে বলা যাবে না এখনো তারা ছুটছে, তাদের গতি যেন আরো বাড়ছে। প্রতি মুহুর্তে পাল্লা দিতে হচ্ছে বড় বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে। আমরা আজকে এই প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস এবং কিছু অজানা তথ্য সম্পর্কে জানবো।
স্যামসাং কোম্পানি জন্মের ইতিহাস-
স্যামসাং কোম্পানির শুরু টা হয়েছিলো লি বায়াং ছুল (চুল?) এর হাত ধরে সেই ১৯৩৮ সালে।কোরিয়ার সু ডং(বর্তমানে ইংগডং) শহরে তিন তলা একটি বিল্ডিং আর সর্বসাকুল্যে ৪০জন শ্রমিকের ৮০ টি হাত, আর মুলধন মাত্র ৩০ ডলার এর সম পরিমান কোরিয়ান ওন।এই নিয়ে যাত্রা শুরু।আপনারা হয়তো ভাবছেন এই সম্পদ দিয়ে কিভাবে আবার এত বড় কোম্পানিতে পরিণত হল? আসলে ব্যাপারটা হল তারা শুরুতে কোন প্রযুক্তি পন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। শুরুতে তাদের কোম্পানির প্রধান পন্য ছিলো নুডলস,অন্যান্য টুকিটাকি খাদ্য সামগ্রি আর তাদের লক্ষ্য ছিল কোরিয়ার খাদ্য সমস্যা দূর করা।
লি বায়াং সাহেব কোম্পানির নাম রাখলেন "স্যামসাং" মানে তিন তারা। তিনি পাঁচ তারা না রেখে তিন তারা রাখলেন কেন?
কারন তিন সংখ্যা টি কে তারা শক্তি ও একতার প্রতীক মনে করে। আর তারা হল অবিনশ্বতার প্রতীক।
স্যামসাং লোগো ১৯৩৮ |
কারন তিন সংখ্যা টি কে তারা শক্তি ও একতার প্রতীক মনে করে। আর তারা হল অবিনশ্বতার প্রতীক।
প্রতিষ্ঠার প্রায় দের দশক পরে তারা কোম্পানি সিউলে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।কোরিয়ার গৃহ যুদ্ধ্যের সময়ও তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। কোম্পানি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হবার ২০ বছরের মধ্যেও তারা কোন দিন কোন প্রযুক্তি পন্য নিয়ে চিন্তাও করতে পারেনি। অথচ তারা আজকে প্রযুক্তির বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ১৯৬০ সালে তারা প্রযুক্তি পন্য নির্মানে হাত দেয়। সর্ব প্রথম বের করে স্যামসাং টিভি, এরপর হাত দিলেন মাইক্রোচিপ সেমিকন্ডাক্টর নির্মানে।
তারপর একে একে, কম্পিউটার, টেলিফোন, ফ্যাক্স মেশিন, ইত্যাদি। পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি আর তাদের। এই বিংশ শতাব্দিতে এসে আমরা যদি হিসেব করি তারা এখোনো কোন প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করেনি, তাহলে সেই লিস্ট টা খালিই থাকবে। কারন, স্মার্ট ফোনের ক্ষুদ্র চিপ থেকে শুরু করে রকেটের ইঞ্জিন, রোবট থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর ট্যাংক কি নেই! এছাড়া বায়ো টেকনোলজি, মেডিকেল টেকনোলজি, ঔষধ শিল্প, জাহাজ শিল্প, ব্যাংক, বীমা,খাদ্য শিল্প সবখানেই তাদের সরব উপস্থিতি। স্যামসাং স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে ১৩ তম। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিনটি স্থাপনা যথা ইউএই তে(United arab emirets) বুর্জ দুবাই, তাইওয়ানে তাইপে ১০১, আর মালয়শিয়াতে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের একটি টাওয়ার তাদের হাতে নির্মিত।
![]() |
স্যামসাং স্মার্ট টিভি |
![]() |
বুর্জ খালিফা |
যাই হোক, ১৯৮৭ সালে তারা একটি বড় ধাক্কা খায়, মানে তাদের অভিভাবক হোয়াম লি বায়াং ছুল ১৯ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। কিন্তু এক বছরের মদ্ধ্যেই তারা আবার এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠেন।দায়িত্ব পরিবর্তন এর মাদ্ধ্যমেই আবার নতুন ভাবে তারা শুরু করে।
১৯৯৩ সালে তারা একটি অভুতপুর্ণ ঘটনা ঘটায়।তারা সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫০০০০(দেড় লক্ষাধিক) মোবাইল ডিভাইস আর ফ্যাক্স মেশিন পুরিয়ে ফেলে। উদ্দেশ্য একটাই, প্রতিষ্ঠানের জনশক্তিদের কে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।এই দশকের শেষে সমস্ত এশিয়াতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায়, কিন্তু স্যামসাং এর উপরে এর কোন প্রভাব পড়েনি। ১৯৯৮ সালে তারা সমস্ত প্রতিষ্ঠান কে একটি ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে, ফলাফল হল ২০০২ সালে তারা আরেক টেক জায়ান্ট সনি কে টেক্কা দেয়।এর পর আজ পর্যন্ত কোন দিন সনি তাদের উপরে যেতে পারেনি।
২০১৩ সালে তারা নতুন প্রযুক্তির ওয়াশিং মেশিন বের করে, যার শুধু বিজ্ঞাপন এবং বিপনন এর জন্যে তারা বিলিওন ডলার খরচ করে কিন্তু কিছু সেলস সেন্টার থেকে অভিযোগ আসে যে তাতে আগুন ধরে যায়। ফলাফল কোম্পানির স্বার্থেই তারা সমস্ত মেসিন বাজার থেকে ঊঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়।(১বিলিয়ন ডলার জানি কতটুকু???কেউ যদি প্রতি সেকেন্ডে ১ ডলার খরচ করে তবে, এই পরিমান খরচ করতে তার সময় লাগবে প্রায় ৪ বছর ৮০ দিন))
এবার আসি এই বিংশ শতাব্দিতে
স্যামসাং এর কিছু অজানা তথ্য নিয়ে:
২০১৪ সালে তাদের মোট রেভিনিউ হল ৩০৫ বিলিয়ন ডলার, তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেক জায়ান্ট অ্যাপল হল $১৮৩ বিলিওন আর গুগলের হল মাত্র ৬৬ বিলিয়ন আর মাইক্রোসফট এর হল $৯৩বিলিয়ন।
শ্রমিক সংখ্যার দিক দিয়েও তারা এগিয়ে, তাদের শ্রমিক সংখ্যা হল ৪লাখ ৯০ হাজার, যা তার নিকটতম তিন প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল, মাইক্রোসফট, আর গুগলের মোট শ্রমিক সংখ্যার থেকে বেশি।তাদের নিজস্ব একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীও আছে। কোরিয়া তে স্যামসাং এর শিপ বিল্ডিং ইয়ার্ড টির আয়তন ৪০০ মিলিওন (১০ লাখ=১মিলিওন) বর্গফুট, যা পৃথিবীর সবচাইতে বড়। এল ট্রিস্টিনো বা মবি ডিকের মত বিশাল বিশাল জাহাজগুলো এখানেই নির্মিত।
স্মার্ট ফোনের বাজারেও তারাই এখন বসঃ
২০১৪ তে বিক্রিত মোট স্মার্ট ফোনের ২৫.২০% হল স্যামসাং এর আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর অ্যাপেলের হল মাত্র ১১.৯%।২০১২ সালে তারা ২১৫৮ লক্ষাধিক স্মার্ট ফোন বিক্রি করে যা তার নিকটতম তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর মোট বিক্রির চেয়েও বেশি।পৃথিবীতে প্রতি ৩ টি ক্রয়কৃত স্মার্টফোনের ভিতর একটি হল স্যামসাং। তবে ২০১৫ তে এসে তাদের গালাক্সি ৬ এবং ৬ এজ আইফোন ৬ এর কাছে মার খেয়ে যায়।
![]() |
গ্যালাক্সি এডজ ৬ |
২০১৪ তে বিক্রিত মোট স্মার্ট ফোনের ২৫.২০% হল স্যামসাং এর আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর অ্যাপেলের হল মাত্র ১১.৯%।২০১২ সালে তারা ২১৫৮ লক্ষাধিক স্মার্ট ফোন বিক্রি করে যা তার নিকটতম তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর মোট বিক্রির চেয়েও বেশি।পৃথিবীতে প্রতি ৩ টি ক্রয়কৃত স্মার্টফোনের ভিতর একটি হল স্যামসাং। তবে ২০১৫ তে এসে তাদের গালাক্সি ৬ এবং ৬ এজ আইফোন ৬ এর কাছে মার খেয়ে যায়।
![]() |
স্যামসাং আলট্রা হাঁই ডেফিনেশান টিভি |
স্যামসাং টেলিভিশন ও কম যায় না। এমলেড টেলিভিশন এর বাজারে ৯৮% তাদের তৈরি।তারা ৮৫ ইঞ্চি আল্ট্রা এইচডিটিভি তৈরী করেছে যার দাম পড়বে প্রায় ৪০০০০ ডলার। আরো মজার ব্যাপার হল তাদের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল তাদের আইফোন ৬ এ যে রেটিনা ডিসপ্লে ব্যাবহার করেছে তার সবই স্যামসাং থেকেই ক্রয়কৃত। মাইক্রোচিপ ও প্রসেসর নির্মানে ইন্টেল এর পরেই তাদের অবস্থান। অ্যাপল তার আইফোন ৪এস, ৫, ৫এস, ৬, ৬এস ও আইপ্যাড ১০.১ এ ব্যবহৃত ৩০% প্রসেসর স্যামসাং এর মাধ্যমে তৈরি করে।
যুক্তরাস্ট্রের ইতিহাসে সবচাইতে বেশি যন্ত্রের প্যাটেন্ট হল ইন্টেল আর স্যামসাং এর। তবে কয়েক বছর ধরে ইন্টেল স্যামসাং কে পেছনে ফেলে রেখেছে।স্যামসাং এর আর একটি অভুতপুর্ণ তথ্য হল, তাদের ১০০% পন্যই "Global Standard Environment Certification" প্রাপ্ত।
আজ এ পর্যন্তই, পোস্টটি পড়ে নতুন কিছু জানতে পারলে তাতেই আমার সার্থকতা। আস সালামু আলাইকুম।
পোস্টটি লিখেছেন- আবদুল্লাহ আল মারুফ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন