শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ করছিল


এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল বলেই সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন পেয়েছে। আন্দোলনকারীদের অধিকাংশ ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। কিন্তু যখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে পুলিশের হাতে মার খেতে থাকল, ছাত্রলীগ কিংবা ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ আক্রমণের শিকার হলো, তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামল। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করা বেআইনি নয়।
গত সোমবার যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঙ্গামা হয়, সেই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছে, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ করছিল। স্থানীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও বহিরাগতরা এসে ভাঙচুর করেছে। গণমাধ্যমের খবরেও বলা হয়, পুলিশ ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কে আক্রমণকারী আর কে আক্রান্ত, নির্ধারণ করবে কে? পুলিশ ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সেদিনের সহিংসতার পেছনে যদি স্বার্থান্বেষী মহল ও বহিরাগতরা কলকাঠি নেড়ে থাকে, তার দায় কেন শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো হবে?
পত্রিকায় ছবি দেখলাম, পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে। রিমান্ড চেয়েছে। সরকার একদিকে বলছে ছাত্ররা সহিংসতা করেনি। অনুপ্রবেশকারীরা সহিংসতা করেছে। অন্যদিকে ছাত্রদেরই হাতকড়া পরানো হলো। রিমান্ডে নেওয়া হলো। এই ছবি দেখে বাবা-মায়েরা কী ভাববেন? তাঁরা তো সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন পড়াশোনার জন্য, কারাগারে বা রিমান্ডে নেওয়ার জন্য নয়।
শিক্ষামন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্ষমা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষমা পেতে পারে না। যেখানে অপরাধ প্রমাণই হলো না, সেখানে ক্ষমার প্রশ্ন আসে কেন? মন্ত্রী মহোদয় হয়তো বলবেন, ক্ষমার কথা উপাচার্যরাই বলেছেন। তাঁরা শিক্ষক। শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁদের সহমর্মিতা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের বাইরে ছিল। দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলেও তদন্তের আগে বলা যায় না, তারাই ফৌজদারি অপরাধ করেছে।
অপরাধ প্রমাণের আগেই শিক্ষামন্ত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি নিজেকে আইনের রক্ষক হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন।
কিন্তু গত নয় বছরে ছাত্রলীগের যেসব নেতা-কর্মী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হানাহানি, মারামারি করেছেন, ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছেন, প্রতিপক্ষকে রামদা-চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কিংবা গুলি করে হত্যা করেছেন, তাঁদের বিষয়ে তিনি বরাবর নীরব থেকেছেন।
আমরা টিভিতে যখন তাঁর সদুপদেশ শুনছিলাম, তখন সিলেট এমএম কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর দৃশ্য মনে পড়ল। শিক্ষামন্ত্রী এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা আগুন দিয়ে ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার পর তিনি আহাজারি করলেও কাউকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারেননি। কেন সেখানে আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি? গত নয় বছরে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা চোখে পড়েনি। তারপরও কেন এত খুনোখুনি, মারামারি, রক্তপাত?
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংঘর্ষে প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে ওই বছরের ৩০ মার্চ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিহত হন কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ। ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের কর্মীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে খুন হন আবু বকর সিদ্দিক নামের এক শিক্ষার্থী। এই খুনের দায়ে কারও শাস্তি হয়নি। সবাই বেকসুর খালাস। প্রথম আলো রিপোর্ট করেছিল, ‘আবু বকরকে কেউ খুন করেনি।’ অর্থাৎ ছাত্রলীগের সংঘাতে কর্মী বা সাধারণ ছাত্র খুন হয়। মামলা হয়। কিন্তু অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছয় বছরে (২০০৯-২০১৪) ৩৯ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান। এ সময়ে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে অন্তত ৪৩২টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৪ জন। নিজ সংগঠনের ৩৯ জনের বাইরে বাকি ১৫ জনের মধ্যে দুটি শিশু এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষ। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি। এই ছয় বছরে অন্য ছাত্রসংগঠনের হাতে ছাত্রলীগের ১১ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।
কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের কর্মী ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসনের (বিবিএ) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন দাস নিহত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অভিযোগ রয়েছে, পদ নিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অন্তঃকোন্দলেই প্রাণ হারান তিনি। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হলে ছাত্রলীগের নেতা নাসিরুল্লাহ নাসিম মারা যান। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই নিহত হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম।
২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়ের আহমেদ একই সংগঠনের কর্মীদের হামলায় নিহত হন। ২০১২ সালের ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল মারা যান। ২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রামে রেলের দরপত্র জমা দেওয়া নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলিতে আট বছরের শিশু আরমান হোসেন ও ২৫ বছরের যুবক সাজু পালিত মারা যান। একই বছরের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারিতে নিহত হয় শিশু রাব্বী।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২ জন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ জনই ‘পলাতক’। এই হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনোটিরই বিচার হয়নি।
শিক্ষামন্ত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক দিন বন্ধ থাকায় বিচলিত বোধ করছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের মারামারিতে যে গত নয় বছরে কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 
বন্ধ ছিল, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, তার হিসাব তিনি নিয়েছেন কি? চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে নিহত সন্তানের বিচারের দাবিতে এক মা অনশন পর্যন্ত করেছিলেন। পরে পুলিশের আশ্বাসে তিনি অনশন ভাঙলেও সেই মামলার অগ্রগতি নেই। ছাত্রলীগের অব্যাহত সংঘাত, সংঘর্ষে শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্বিগ্ন হতে দেখি না। এমনকি সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলন দমন করতে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা যখন ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন 
স্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়, লাঞ্ছিত ও আহত করে, তখনো তিনি নির্বিকার ছিলেন।
শিক্ষামন্ত্রী হয়তো নির্দেশিত হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘লঘু পাপে’ গুরুদণ্ড দেওয়ার কথা বলছেন। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু যারা নয় বছর ধরে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও হানাহানি চালিয়ে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন আইন নিজস্ব গতিতে চলছে না, অনুগ্রহ করে তিনি সেই প্রশ্নের জবাব দেবেন কি?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আইক্লাউড লক কি? লক বাইপাস করার উপায়?

NSU MGT 314 (Supply Chain/ Production Management), Few Questions and answers

ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চোরদের ব্লক করুন এক নিমিষেই