রেড ওশেন টু ব্লু ওশেন স্ট্রাটেজি (কিভাবে প্রতিযোগীতামূলক ব্যবসায়ে টিকে থাকবেন)
রেড ওশেন মানে লাল সাগর যেই মার্কেটে একই ক্যাটাগরির প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের অনেক প্রতিযোগীতা,
তাই রেড ওশেন মার্কেটে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিকে হারানোর জন্য কোম্পানির নতুন নতুন ইউনিক আইডিয়া বের করতে হয় আর মার্কেটে নতুন কোন কোম্পানিকে ঢুকতে হলে একদম সবার থেকে আলাদা কৌশল নিয়ে আসতে হয় যেন কম্পিটিশনকে কম করে ব্লু ওশেন মার্কেট কনভার্ট হতে পারে, নতুবা নতুন মাল কাস্টমারকে গছানো সম্ভব না।
♣প্রথম উদাহরন ভারতের জিও মোবাইল কোম্পানি -
ভারতের মোবাইলের মার্কেটে অলরেডি এয়ারটেল,টাটা,বি এস এন এল,ভোডাফোন,আইডিয়া সহ ১৩ টা কোম্পানি ব্যবসা করছিলো।
পুরাটাই রেড ওশেন মার্কেট; সেখানে আবারো নতুন আরেকটা মোবাইল কোম্পানি চলে আসলো কিন্তু গেইম পুরোটাই চেঞ্জ করে ফেলেছে।
📌কিভাবে?
মুখেশ আম্বানি ২.৫ লাখ কোটি টাকা ইনভেস্টমেন্ট করে মোবাইল সেক্টরে। প্রথম 'ফোর জি' নিয়ে আসে ভারতে! এরপর ফ্রি তে 'ফোর জি' সিম দেয়া শুরু করলো পাবলিককে এবং 'ফ্রি ইন্টারনেট' ডাটা।
সেই ফ্রি 'ফোর জি ' সিম ব্যবহারের জন্য 'ফোর জি মোবাইল দরকার। কাস্টমার সব হুমরি খেয়ে ফোর জি সাপোর্ট মোবাইল কেনা শুরু করলো এবং জিও ফ্রি তে ফোর জি মোবাইল ও কাস্টমারকে দিয়েছে।
যেখানে একদিকে অন্যসব কোম্পানি টু-জি থেকে ভালোমতো থ্রি-জি কনভার্টে হামাগুরি দিচ্ছিলো সেখানে জিও "ফাল হয়ে ঢুকে সুই হয়ে বের হয়ে গেলো" তাদের ফোর- জি ইনোভেশনের মাধ্যমে।
এন্ট্রি ব্যারিয়ার তৈরী করে দিল, কারো ক্ষমতাই নাই জিও-র সাথে কম্পিট করবে।ভোডাফোন আর আইডিয়া অলড়েডি মার্জ হয়ে গিয়েছে জিও র সাথে টিকে থাকার জন্য আর বাকি অন্য সব কোম্পানি বন্ধ হবার উপক্রম। মার্কেট শেয়ারের অবস্থা করুন।
এখানে দেখুন আম্বানি যদি অন্যসব কোম্পানির মতোই টু জি, থ্রি জি সার্ভিস নিয়ে বাজারে নামতো কেউই পুরনো এয়ারটেল,ভোডাফোন,আইডিয়া এইসব সার্ভিস
প্রোভাইডারদের ছেড়ে জিও তে আসতো না।
কাস্টমার জিও কে বলতো "ভাই তুমি জিও আমাকে যেই সার্ভিস দিবা, আমার সমস্যার যেই সমাধান দিবা। এয়ারটেল, ভোডাফোন অন্যরা তো আমাকে সেই একই সার্ভিস'ই দিচ্ছে। আমার সমস্যা তো সমাধান হচ্ছেই তাদের দ্বারা! তো খামাখা আমি তোমার কাছে কেনো যাবো?"
আরো ভালো একটা উদাহরন দেই " বাজারে পেইন কিলারের অভাব নেই ঠিক না? আমরা কম বেশি সবাই পেইন কিলার খাই ব্যাথা হলে। এখন আপনি যেই নামের পেইন কিলার খাচ্ছেন সেই ওষুধে যদি আপনার সমস্যা সমাধান হয় বাজারে আরেকটা নতুন নামের পেইন কিলার একই দামে একই কোয়ালিটি নিয়ে এসে আপনাকে যদি বলে আমারটা ট্রাই করে দেখেন।
আপনি কিনবেন ওই নতুন পেইন কিলার?
অবশ্যই না ; কেন নিবেন না?
- কারন প্রথমত, আপনার সমস্যার সমাধান আপনি আগের পেইন কিলারেই পাচ্ছেন।
- দ্বিতীয়ত, নতুন ওই ওষুধ এক্সট্রা কোন বেনিফিট দিচ্ছেনা, ভ্যালু এড করতে পারেনি। সেই সাথে মনের সন্দেহ যে কেমন না কেমন হয় কাজ হবে কি হবেনা?
যেখানে অলড়েডি আগের ওষুধে কাজ করতেছে সেখানে এই নতুন ওষুধ যতক্ষন না অন্যদের চাইতে বেটার পারফরমেন্স এবং দামের ছাড় না দিচ্ছে ততক্ষন আপনি কেনার জন্য চিন্তাও করবেন না।
👉শিক্ষা ১-
- মুখেশ আম্বানির টাকার সমস্যা নেই তাই লেইট মুভার হওয়াতেও কোন সমস্যা হয়নি। আপনার কাছে এত টাকা ইনভেস্ট করার মত ক্ষমতা নাই তাই ছোট ছোট ইনোভেশন,কাস্টমার প্রোগ্রাম, ডিসকাউন্ট, প্রোডাক্ট ডেভোলপম্যান্টে মনোযোগ দিন।
- "সবাই মুদি দোকান খুলে বসে যাচ্ছে লাভ আছে,তাই বলে আপনিও দেখাদেখি মুদি দোকান দিয়ে বসে থাকলে সবাই যা পাচ্ছে আপনিও তাই পাবেন।
দ্বিতীয় উদাহরন প্রানের মিস্টার নুডুলস -
ম্যাগি নুডুলস বাজারে মার্কেট লিডার। আমরা সবাই ম্যাগী নুডুলস খেয়েই কম বেশি বড় হয়েছি। কিন্ত হুট করে মিস্টার নুডুলস বাজারে আসলো আর ধুম ধাম মার্কেট শেয়ার ধরে নিল।
মিস্টার নুডুলসের এত দ্রুত মার্কেট ধরার কারন একটাই "সিপি(কাস্টমার প্রোগ্রাম)।
নুডুলসের সাথে গিফট প্রদান করা ; যেখানে ম্যাগী বছরে একটা নির্দিষ্ট সময় সিপি দিয়ে থাকে বা দেয় ও না সেখানে মিস্টার নুডুলস এমন ও হয়েছে সারাবছর সিপি চালিয়ে নিয়েছে।
কাস্টমার হুমড়ি খেয়ে কেনার জন্য চলে আসে। আমাদের মায়েরা টাকা বাচাতে সব সময় অনেক সচেতন। ফ্রি ফ্রি ৪০-৫০ টাকার একটা প্লাস্টিকের মগ বা বাটি বা জগ পাচ্ছে সেই সুযোগ তারা লুফে নিতে মরিয়া হয়ে থাকে৷
📌প্রান এই অফারটা কেনো দিতে পারে?
আমরা জানি প্রানের আলাদা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে, সেখানে দেখা যায় তাদের অনেক এক্সট্রা কাচামাল থাকে এবং আলাদাভাবে এই প্লাস্টিকের অফার'টা দেবার জন্য তাদের মাল কিনতে হয়না অন্যদের থেকে! নিজেদেরই কোম্পানি আছে! সেখানে তারা কস্ট এডভান্টেজ পায়। আর সেই সুযোগ টাকে কাজে লাগিয়ে নুডুলসের সাথে এই প্লাস্টিকের কিছু একটা সিপি অফার দিয়ে কাস্টমারকে ধরে নিয়েছে। এন্ট্রি ব্যারিয়ার দিয়ে দিয়েছে, কারন অন্য কোন কোম্পানি এভাবে সারাবছর সিপি দেবার মত টাকা ইনভেস্ট করতে পারবেনা। প্রানের ইন হাউজ প্লাস্টিক ইণ্ডাষ্ট্রি এই কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ তৈরীর একমাত্র কারন।
👉শিক্ষা ২ -
আপনার যদি এরকম এক্সট্রা এডভান্টেজ পাবার মত ইন হাউজ কোন সুবিধা থাকে যা তৈরী করে কাস্টমারকে সিপি দিতে পারেন। কিন্তু সবাই তো প্রানের মত এত বড় কোম্পানি হতে পারেনি। তাই কাছাকাছি রিলেটেড কিছু এড করা যেতে পারে অথবা মার্কেট টিকে থাকার জন্য USP (Unique Selling Proposition) বের করতে হবে,
তৃতীয় কেইস স্টাডি ইউনিলিভার বাংলাদেশ
- কঞ্জ্যুমার গুডস, বাজারে কোম্পানির অভাব নেই কিন্তু এই মার্কেটে মার্কেট লিডার ধরা হয় ইউনিলিভার,এসি আই,প্রান আর এফ এল, স্কয়ার ইত্যাদি আরো বড় কোম্পানি যেগুলো আছে।এই কোম্পানিগুলো সবার ডিস্ট্রিবিউশন অনেক স্ট্রং!
ইউনিলিভার তার ডিস্ট্রিবিউশন কে আরো শক্ত করার জন্যে ''পল্লীদুত "নামে একটা মডেল বের করেছে। আমি আমার ইউনিলিভারের কেইস স্টাডিতে লিখেছিলাম যারা পড়েননি লিংক দিব নিচে পড়ে নিতে পারেন।
পল্লীদুত মডেল বের করার পেছনে কারন হচ্ছে "প্রত্যন্ত এরিয়া যেখানে ডিস্ট্রিবিউশন সার্ভিস পৌছায় না সেখানে মাল পৌছে দেবার জন্যেই এই মডেল বের করা হয়"
যেকোন ব্যক্তি তার পার্সোনাল সাইকেল বা ভ্যান বা মোটর সাইকেলে করে পন্য তার কাছাকাছি ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট থেকে নিয়ে ওই সব ছোট ছোট রিটেইলার দোকান গুলোতে সাপ্লাই দিতে পারে যেসব দোকানে যাবার জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল না অথবা ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারের এরিয়া থেকে অনেক দুরে কিংবা যেখানে মাল খুব বেশি বিক্রি হয়না!
যেমন- দেখা যায় কোন দোকানের সাইজ ছোট বা পুজি কম অথবা মালের বিক্রি অতো বেশি না এবং গ্রামের মহল্লার পাড়ার মধ্যে দোকান যেখানে কোন এস আর পৌছায় না কিংবা মাল ডেলিভারি ম্যান মাল ডেলিভারি নিয়ে যাওয়া লাভের চাইতে লস বেশি। সেই দোকানে দেখা যায় ৫-১০ টা লাক্স সাবান লাগে তাও আবার অনেক দুরে দুরে এলাকা বা মহল্লা বা পাড়ার দোকান।
তো সেই দোকানে তো ডিস্ট্রিবিউটরের এস আর কে পাঠানোটা লাভের চাইতে লস বেশি তাই এই সমস্ত দোকান গুলোতে মাল সাপ্লাই দেবার জন্যেই এরকম ব্যক্তি উদ্যোক্তা মডেল যাকে ইউনিলিভারের পল্লীদুত মডেল বলা হয়। এই মডেলের কারনে ইউনিলিভার অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে গেল।
👉শিক্ষা ৩ -
ডিস্টিবিউশন কে কেন শক্ত করতে হয় বড় বড় কোম্পানির?
কিছুদিন আগে আমি আমার এলাকায় আর সি কোলা চাইছিলাম ; পাইনি, কারন এখানে পাওয়া যায়না। তার বদলে আমি ক্লেমন কিনেছি। আরসি প্রমোশন করেছে ঠিক'ই কিন্তু সাপ্লাই দুর্বলের কারনে আমি আরসির কাস্টমার একুইজেশন কষ্ট আমাকে অন্য কোম্পানির পন্য'টা কিনতে বাধ্য করেছে।
এখন লাক্সের কথা সবাই জানে বাচ্চা থেকে বুড়া সবাই চিনে লাক্স এক নামে। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের এরিয়াতে কেউ যদি লাক্সের বিজ্ঞাপন বা মুখের প্রচার শুনে দোকানে এসে লাক্স চায় আর দোকানদার যদি লাক্স না দিতে পারে তখন অন্য ব্রান্ডের সাবান থাকলে কাস্টমারকে দোকানদার বলবে" ভাই লাক্স নাই মেরিল বা অন্য যেকোন একটা আছে বলল।
স্বাভাবিক কাস্টমার ওইটাই নিবে যেহেতু লাক্স নাই। একটা সাবানের জন্য তো আর সে বাজারে যাবেনা।
আর ওই সাবান যদি ভাল লাগে কাস্টমারের, পরবর্তীতে সে আর লাক্স চাইবে না ওইটাই চাইবে।
এতে করে লাক্সের একজন কাস্টমার একুইজেশন করতে বিজ্ঞাপনের যেই টাকা খরচ করল সাপ্লাইয়ের অভাবে একজন পটেনশিয়াল কাস্টমারকে হাতছাড়া করতে হল। এই জন্যেই প্রোডাক্টের ভিজিবিলিটি আর এভেইলেভেলিটি থাকা জরুরি।
ভিজিবিলিটি আর এভেইলেভিলিটি কিভাবে সেলস বাড়াতে পারে তা নিয়ে ইউনিলিভারের কেইস স্টাডিতেও লিখেছিলাম, পড়ে নিতে পারেন নিচের লিংকে
লিখা অনেক বড় হয়ে যায়। তাই বাকিগুলো পড়ের পর্বে দিব...
চলবে....
Rony Ahmed
University Of Chittagong
Department Of Marketing (MBA)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন