ইভ্যালির ভেলকি?
সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট কি?
মূল সরবরাহকারী ছোট কোন সরবরাহকারীকে বাকিতে মালামাল দেয়। তার বিনিময়ে সে চেক রাখে বা কোন গ্যারান্টি রাখে বা সরল বিশ্বাসেও দিয়ে দেয়।
একসময় আমাদের কম্পিউটার মার্কেটে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট দোকানের মালিকদের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট দিতেন। এরপর শুরু হলো চেক রেখে মাল দেয়া। তারপর নানাভাবে গ্যারান্টি নিয়ে মালামাল দেয়া হতো। অনেক ব্যবসায়ী যে দামে মাল নিতেন তার চেয়ে কমদামে বেচে দিয়ে দোকান সহ লাটে তুলতেন। এর কারণ হলো সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট যাকে দেয়া হচ্ছে তার কোন ক্রেডিট রিস্ক অ্যানালাইসিস থাকতো না। বড় ব্যবসায়ীরা গাট ফিলিং থেকে এই ক্রেডিট দিতেন ও চেক নিতেন। অনেক দেনাদার ছোট ব্যবসায়ী যেটা করতো সেটা হলো বহুদিন ভালো লেনদেন রেখে নিজের দেনা বাড়িয়ে হঠাৎ লালবাতি জ্বালাতো। একসময় এমন হয়েছিলো যে কম্পিউটার সমিতির কর্তাব্যক্তিদের বিরাট একটা সময় কাটতো শালিস বিচার করে করে।
বড় ব্যবসায়ীরা এই বাকি দিতো ব্যাংক থেকে সিসি নিয়ে। ফলে দিনের শেষে ব্যাংক বিপদে পড়তো। এরপর ব্যাংক নিজের গুদামে মাল রেখে দিতে শুরু করলো। আমাদের সব ব্যবসা এভাবে বিপদে পড়ে কারণ আমরা সমস্যার পরে নিয়ম বানাই। আগে থেকে রেগুলেশন নিয়ে ভাবি না। এখন ই কমার্স সাইটগুলি কি করে? তাদের মূলধন হলো একটা ওয়েব পোর্টাল ও অ্যাপ আর কিছু কর্মী। তারা তাদের মাধ্যমে পণ্য কেনা বেচার সুযোগ ও হোম ডেলিভারীর মাধ্যমে ক্রেতা বিক্রেতার সুবিধা ও বিক্রি দুটোই বাড়ায়। কোন ই কমার্স সাইট যদি আপনার কাছ থেকে অগ্রীম নেয় ও ৪৫ বা ৬৫ দিন পরে মাল দেবে বলে অংগীকার করে, তার মানে হলো সে এই দেড় বা দুমাসের জন্য আপনার কাছ থেকে টাকা ধার নিলো। এই টাকা ধার পাওয়ার জন্য সে আপনাকে বড় অংকের মূল্যছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার করলো। এজন্য আপনি তাকে এই দুমাসের জন্য টাকা দিলেন। সে বিক্রেতার কাছ থেকেও বাকিতে মাল নিলো। সেটাও দুমাস পরে দেবে বললো। তাহলে সে আপনার কাছ থেকে দুমাস টাকা নিয়ে রেখে দিলো। আর দুমাস পরে আপনাকে মাল দিলো বিক্রেতার কাছ থেকে দুমাসের ধার নিয়ে। সে এভাবে চার মাস আপনার ও আপনার বিক্রেতার টাকা নিজের কাছে রেখে দিলো। সমস্যা হলো ডিসকাউন্ট বা ছাড়।
সে আপনাকে ৫০% ছাড় দিয়েছে। এই টাকা সে কোথায় পাবে? মনে করেন এই ছাড়ে ৩০% তার লাভ থেকে ছেড়েছে। তারপরেও তো ২০%। এটা সে যোগান দেয় আপনার পরে যে টাকা দিচ্ছে তার টাকা থেকে। এটাকে সে লস বলছে। একটাকা আয় করতে সে সাড়ে তিনটাকা খরচ করে। কিভাবে করে? বাকি আড়াই টাকা কোথা থেকে পায়? কিন্তু এটা তো কোম্পানীর আয় বা কোম্পানীর ডিরেক্টরদের টাকা থেকে দেয়া লস না। সে আপনার টাকা আরেকজনের পকেটে দিয়ে লস দিচ্ছে। তাতে তার দেনা বাড়ছে কিন্তু সেটা তার নিজের জমি বাড়ী গাড়ী বেচা পয়সা থেকে ক্ষতি না। সে পণ্য না দিলে লাভ সহ টাকা দিয়ে দিচ্ছে। সেটা কিভাবে দিচ্ছে । লস করা কোম্পানী বাড়তি ক্যাশ কোথা থেকে পায়? বরং সে আপনার টাকা নিয়ে লস করে বাড়ী গাড়ী কিনছে। রেঞ্জরোভার , ধানমন্ডিতে আট কোটি টাকার ফ্ল্যাট, লাখ টাকার কম্পিউটার এসব কিনছে। তারকা ভাড়া করে বিজ্ঞাপন করছে। আপনি ভাবছেন এই কোম্পানী তো দারুন। তার মনের আগ্রহ কি? সে এই কোম্পানী আমাজন, ফ্লিপকার্ট বা অন্য কেউ কিনে নেবে বলে ভাবছে। তখন সে বিরাট একটা ক্লায়েন্ট বেস সহ সাইটটা বেচে দেবে।
আমাজন বা আলিবাবা চার পাঁচশ কোটি টাকা লস দিয়ে ও তাকে কিছু টাকা দিয়ে আসলে বিরাট ক্লায়েন্ট বেস টা কিনবে ও এসব দায় দেনা শোধ করে দেবে। এই ফাটকাবাজিতে সে আপনার আমার বিশ্বাস ও টাকা জুয়াড়ীর মতো ব্যবহার করছে ও বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থব্যবস্থা ও দুর্বল আইনকে কাজে লাগাচ্ছে। এজন্য চার মাসে আলিশামার্ট বা সিরাজগঞ্জ নামের অদ্ভুত সাইটগুলিও শত শত কোটি টাকা লেনদেন করে ফেলছে। মনে রাখবেন নিয়মের মধ্যে কাজ করা কঠিন। অনিয়ম করা খুব সোজা। সমস্যা হলো এরকম অনিয়ম ও হিসাবের গরমিল করে আমাজন বা আলিবাবার কাছে ব্যবসা বেচে দেয়া সোজা না। এরা এসব বোঝে বলেই এখন দেশে প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের মতো অডিট কোম্পানীও চলে এসেছে। পিপড়াকে হাতি বলে বেচে দেয়া এখন সহজ না। লিমিটেড কোম্পানী কাকে বলে জানেন তো। এই কোম্পানীর দায় সীমিত। তার মানে আপনার টাকা কোম্পানীর সম্পদ থেকে শুধতে হবে। কোম্পানীর দায় যদি হয় ৪০০ কোটি আর সম্পদ ২৬ কোটি তাহলে আপনার টাকা কোম্পানী বেচে পাওয়া যাবে না। আর কোম্পানী যখন লালবাতি জ্বালায় তখন তার গুডউইল বলে কিছু থাকে না।
অতএব কোন কোম্পানী যদি বলে আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু হিসাব করেন। তাকে বুঝতে হবে চোরের ব্র্যান্ড ভ্যালু চুরি ধরা পড়ার পরে আর থাকে না। সাধুর ব্র্যান্ডভ্যালু মরে গেলেও বাড়ে। এটা ততক্ষনই ব্র্যান্ড যতোক্ষন তার বদনাম নাই। বদনাম বাড়লে ব্র্যান্ড ভ্যালু কমে। একটা কোম্পানী যদি ক্রেতা ও বিক্রেতা দু পক্ষের কাছেই দেনাদার হয়, সে কোম্পানীর লালবাতি জ্বলবেই। কারণ ক্রেতা তাকে পূর্ণ মূল্য দেয়ার পরেও সাপ্লায়ার কেন ক্রেডিটে থাকবে? তার মানেই হলো সে কাউকেই মূল্য পরিশোধ করছে না।
আপনাকে পণ্য দিচ্ছে না আর বিক্রেতাকে মূল্য দিচ্ছে না। তাহলে আপনার কাছ থেকে নেয়া টাকাটা কি করছে? আরেকজনকে মূল্যছাড় হিসেবে দিয়ে দিচ্ছে আর আপনাকেও আরেকজনের কাছ থেকে নিয়ে দেবে বলে ভাবছে।
লিখা:- ডা. আব্দুন নুর তুষার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন